মুম্বাই, ২৯ এপ্রিল- বিশ্বজোড়া খ্যাতি আর শোকেজে সাজানো অসংখ্যা নামী দামি সম্মাননা ফেলে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বলিউডের নামজাদা অভিনেতা ইরফান খান। তার ঝুলিতে রয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’সহ অনেক পুরস্কার। জীবদ্দশায় ইরফান খান ৫০টিরও বেশি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন হলিউডের বেশ কয়েকটি ছবিতেও। ভারতীয় চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী এবং অন্যান্যরা তাকে হিন্দি সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করেন।
কিন্তু মাত্র ৬০০ টাকা কম থাকায় ক্রিকেট ছেড়ে অভিনয়ের জগতে পা রেখেছিলেন প্রয়াত ইরফান খান। ২০১৪ সালে এই কথা জানিয়েছিলেন এই অভিনেতা। তার আকস্মিক প্রয়াণের পর সেই তথ্যই আরও একবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সবার সামনে।
মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বলিউড তথা হলিউড কাঁপানো অভিনেতা ইরফান খান। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। সেই অবস্থাতেই হিন্দি সিনেমা আংরেজি মিডিয়ামে অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়েছিলেন ইরফান। ২০১৪ সালে ইরফান খান জানিয়েছিলেন, প্রথমেই তিনি অভিনেতা হতে চাননি। বরং শৈশব থেকে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সে অনুযায়ী তিনি জয়পুরে ক্রিকেটের অনুশীলনও শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি ক্রিকেট মাঠে অলরাউন্ডারের ভূমিকা পালন করতেন বলে জানিয়েছিলেন।
ইরফান খান জানিয়েছিলেন, জয়পুর দলের হয়ে ক্রিকেট খেলার সময় তিনি সিকে নাইডু টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান। তিনি জয়পুরের কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে এই সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে তিনি অভিনয়ের জগতে পা রাখেন বলে জানিয়েছিলেন ইরফান খান।
সিকে নাইডু ট্রফিতে খেলার জন্য সেই সময় তার ৬০০ টাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি সেই টাকা জোগাড় করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, সেদিনই তিনি তার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছিলেন। উল্টো ৩০০ টাকা দিয়ে তিনি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে ভর্তি হয়েছিলেন। যদিও সেই টাকা তার দিদি জোগাড় করে দিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটের প্রতি একটা অদ্ভূত বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল ইরফানের। না একেবারেই নিজে ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে নয়। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে ‘পান সিং তোমার’ অভিনেতা বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির চাদরে মোড়া ক্রিকেট এখন সময় নষ্ট মাত্র।’ টি-২০ ফর্ম্যাট জেন্টলম্যান’স গেমের মারাত্মক ক্ষতি করছে বলে মনে করতেন ইরফান। ছোটবেলায় একবার ভারত-পাক ম্যাচ দেখতে গিয়ে অভিনেতা ছুটেছিলেন জাহির আব্বাসের অটোগ্রাফ নিতে। ওটাই ছিল ইরফানের জীবনে প্রথমবার কোনও ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ। হ্যাঁ, জাহির আব্বাসের এতটাই ভক্ত ছিলেন তিনি।
ইমরানও কম যেতেন না। ইমরানের লম্বা সুঠাম চেহারা আকৃষ্ট করত ইরফানকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ইরফানের পছন্দের তালিকায় ছিলেন ডেভিড বেকহ্যামের মতো ফুটবলারও। তবে ফুটবলটা ওনার ‘কাপ অফ টি’ ছিল না একেবারেই। এরপর একে একে ভালোলাগার লিস্টে সচিন তেন্ডুলকর, কপিল দেব, মহেন্দ্র সিং ধোনি। তবে সাম্প্রতিক সময় অবসরে টেনিসে মজে থাকতেন লাঞ্চবক্সের সজন ফার্নান্ডেজ কিংবা কারওয়ানের শওকত। রাফায়েল নাদালের অন্ধ ভক্ত ইরফানের টেনিস দেখা শুরু যদিও পিট সাম্প্রাসের জন্য। টেনিসের আলোচনা হলেই মার্কিনীর পাওয়ালফুল সার্ভিসের কথা ইরফান বলবেনই। পছন্দের তালিকায় ছিলেন রজার ফেডেরারও।
ভারতীয় এই অভিনেতার মৃত্যুতে সোশাল মিডিয়া যেন হয়ে উঠেছে শোক মঞ্চ। কিংবদন্তীর মৃত্যুতে শোকাহত ক্রীড়াঙ্গনের মানুষেরাও। তার মৃত্যুতে স্তব্ধ শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলি থেকে শুরু করে ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে আর বীরেন্দ্র শেবাগও। সবাই ইরফানের এমন বিদায়ে শোকাহত।
টুইটারে শচীন লিখলেন, ‘খবরটা শুনে খুব খারাপ লাগছে। ও আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতার একজন। আমি ওর প্রায় সব ছবিই দেখেছি। ওর শেষ সিনেমা আংরেজি মিডিয়ামও দেখেছি! অভিনয়টা ওর কাছে যেন কোনো ব্যাপারই ছিল না! ও সত্যি অসাধারণ! ওর আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
ক্রিকেটার ইরফানের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বিরাট কোহলিও। ভারতীয় অধিনায়ক তার টুইটে লিখলেন, ‘ইরফান খানের মৃত্যুর কথা শুনে দুঃখ পেয়েছি। কী অসাধারণ প্রতিভা! ভার্সেটাইল এই অভিনেতা তার অভিনয় দিয়ে সবার হৃদয় স্পর্শ করেছেন। ঈশ্বর উনার আত্মাকে শান্তি দান করুন।’
ক্রিকেটটা পেশা হয়ে ওঠেনি কারণ, সঠিক সময়ে ইরফানের উপলব্ধিটা হয়তো এক্কেবারে সঠিক ছিল। এমন বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আত্মবিশ্বাসী ক’জনই বা হতে পারেন। ছোটবেলার স্বপ্ন ক্রিকেটকে বিসর্জন দিয়ে অভিনেতা হিসেবে ভালোবাসা কুড়িয়ে নিলেন এক পৃথিবী মানুষের।